বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রিফাতের বাবার সংবাদ সম্মেলনের পরদিন এবার সংবাদ সম্মেলনে করছেন এ হত্যাকাণ্ডে আলোচনায় আসা রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেছেন, গতকাল তার শ্বশুর সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন তা মনগড়া ও বানোয়াট। শ্বশুরের সংবাদ সম্মেলনের তীব্র প্রতিবাদও জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ দাবি করেছিলেন, আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি আগে নয়ন বন্ডকে বিয়ে করেছিল। ওই বিয়ে গোপন করে রিফাত শরীফকে বিয়ে করে মিন্নি। বিষয়টি আমাদের জানায়নি মিন্নি এবং তার পরিবার। কাজেই রিফাত শরীফ হত্যার পেছনে মিন্নির মদদ রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনলে সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
লিখিত বক্তব্য মিন্নি বলেন, ‘গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে আমার স্বামী রিফাত শরিফকে নয়ন বন্ডসহ কতিপয় সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে। সেই হত্যার ভিডিও প্রকাশ পেলে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য আমি যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অস্ত্রের মুখে প্রতিবাদ করেছি, তা দেখে সারা দেশের মানুষ আমার সাহসের প্রশংসা করেছেন। পরবর্তীতে আমার শ্বশুর নয়ন বন্ডসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় উল্লেখ নেই যে, আমি স্বামী হত্যার সঙ্গে জড়িত, বরং ওই মামলায় আমি ১ নম্বর সাক্ষী।’
মিন্নি বলেন, ‘বর্তমানে আমার শ্বশুর অসুস্থ এবং তার একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। যখন যা বলেন পরে তা মনে থাকে না। উল্লেখ থাকে যে, রিফাত হত্যায় আসামিরা বিচারকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাকে হয়রানির চেষ্টা করেছে। যেমন, ফেসবুকে বিভিন্ন ছবি এডিট করে পোস্ট করেছে যা কখনোই সত্য নয়।’
সংবাদ সম্মেলনে মিন্নি বলেন, ‘০০৭ নামে যে গ্রুপটি বরগুনায় যারা সৃষ্টি করেছেন তারা খুবই ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী। তাই তারা এই বিচারের আওতা থেকে দূরে থাকার জন্য আমার শ্বশুরকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে রিফাত হত্যার বিচারকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য শনিবার বরগুনা প্রেসক্লাবে আমার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন যা সম্পূর্ণ মনগড়া ও বানোয়াট। আমার শ্বশুরের সকল বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানাই আমি। আমার স্বামীকে কোপানোর পরে তাকে আমি বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে রেফার করার কথা শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি এবং জ্ঞান ফিরলে আমি জানতে পারি।’
নিহত রিফাতের স্ত্রী আরও বলেন, ‘আমার নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বরগুনার পুলিশ সুপারকে ধন্যবাদ জানাই। আমি এক স্বামীহারা অসহায় নারী, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি।’
এর আগে শনিবার রাত ৮টার দিকে এ সংবাদ সম্মেলন করেন নিহত রিফাত শরীফের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ। সংবাদ সম্মেলনে নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান শ্বশুর আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ।
তিনি বলেন, আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি আগে নয়ন বন্ডকে বিয়ে করেছিল। ওই বিয়ে গোপন করে রিফাত শরীফকে বিয়ে করে মিন্নি। বিষয়টি আমাদের জানায়নি মিন্নি এবং তার পরিবার। কাজেই রিফাত শরীফ হত্যার পেছনে মিন্নির মদদ রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনলে সব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এদিকে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার আগের দিনও নয়ন বন্ডের বাসায় গিয়েছিলেন নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। মিন্নি যে নয়নের বাসায় গিয়েছিল তা প্রতিবেশীরাও দেখেছে। আলোচিত এ ঘটনার ১৮ দিনের মাথায় এমন বিস্ফোরক তথ্য দিলো নয়ন বন্ডের মা।
তিনি বলেন, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২৬ জুন বুধবার। এর আগের দিন মঙ্গলবারও মিন্নি আমাদের বাসায় এসে নয়নের সঙ্গে দেখা করে। আমার ছেলে তো মারাই গেছে। আমার তো আর মিথ্যে বলার কিছু নেই। মিন্নি যে মঙ্গলবারও আমাদের বাসায় গিয়েছিল তা আমার প্রতিবেশীরাও দেখেছে।
‘
নয়ন বন্ডের মা বলেন, শুধু হত্যাকাণ্ডের আগের দিন মঙ্গলবারই নয়; রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পরও মিন্নি নিয়মিত আমাদের বাসায় এসে নয়নের সঙ্গে দেখা করত। মোটরসাইকেলে মিন্নিকে রিফাত শরীফ কলেজে নামিয়ে দিয়ে চলে যেত। এরপর মিন্নি আমাদের বাসায় চলে আসত। আবার কলেজের ক্লাস শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে মিন্নি আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে কলেজে যেত।
শাহিদা বেগম বলেন, রিফাতের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের খবর পাওয়ার পর আমি আমার ছেলেকে অনেক নিষেধ করেছি, যোগাযোগ না রাখতে। কিন্তু আমার ছেলে নয়ন কখনও আমার কথা শুনত না। ওর মনে যা চাইতো ও তা-ই করত। নয়ন যদি আমার কথা শুনত তাহলে এমন নির্মম ঘটনা ঘটত না।
রিফাতের সঙ্গে বিয়ের পরও নিয়মিত নয়ন বন্ডের বাসায় আসা-যাওয়া এবং হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও নয়ন বন্ডের বাসায় যাওয়ার বিষয়ে শনিবার সকালে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের ফোনে কল দিয়ে মিন্নির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, মিন্নি অসুস্থ। গতকাল তাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। মিন্নি এখন ঘুমাচ্ছে। তাই মিন্নি কথা বলতে পারবে না।
এছাড়া মিন্নির সঙ্গে কথা বলতে হলে বরগুনা জেলা পুলিশের অনুমতি লাগবে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে স্ত্রী মিন্নির সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ওইদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
নিহত রিফাত শরীফের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬নং বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে। তার বাবার নাম আ. হালিম দুলাল শরীফ। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন রিফাত।
রিফাত হত্যাকাণ্ডের পরের দিন অর্থাৎ ২৭ জুন মিন্নি গণমাধ্যমের কাছে কাঁদতে কাঁদতে দাবি করেন, আমার চোখের সামনেই আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা। অনেক চেষ্টা করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারিনি আমি। আমি তাদের বিচার চাই।
গত শুক্রবার থেকে রিফাত ও মিন্নির বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ জানায়, মিন্নি এ মামলার প্রধান সাক্ষী। তার নিরাপত্তার জন্য তার বাড়ির বাইরে পুলিশ রাখা হয়েছে।
দেশব্যাপী আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলার প্রধান অভিযুক্ত নয়ন বন্ড গত ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ওইদির ভোররাতে বরগুনার পুরাকাটা এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। নয়ন বন্ডের নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন।